মায়ের কোল থেকে সন্তান কেড়ে আগুনে নিক্ষেপ মিয়ানমার সেনাদের
‘আগে গুলী পরে প্রশ্ন’ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়েছে
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সহিংসতা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত ৬৯ জন রোহিঙ্গা মুসলমান ছাড়াও দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ১৭ জন নিহত হয়েছে। সিএনএন মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে ‘শুট ফার্স্ট, আস্ক কোশ্চেন লাটার’ : ভায়োলেন্স ইনটেসিফাইস ইন রাখাইন এস্টেট। সেখানকার পরিস্থিতি আরো সংকটজনক হয়ে উঠছে। তবে অন্যান্য সূত্রগুলো বলছে নিহতের সংখ্যা আরো বেশি। আটক করা হয়েছে ২৩৪ জনকে।
মিয়ানমার সরকার যদিও বলছে রাখাইনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে কিন্তু দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন, তাদের হত্যা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখনই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে তখনই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ বাহিনীর সদস্যরা আগে গুলী করছে, এরপর কোনো প্রশ্ন থাকলে তা জিজ্ঞাস করছে। তাদের রেকর্ড বরাবরই বিশ্রি ধরনের।
রবার্টসন বলেন, রাখাইন স্টেটে নির্বিচারে গ্রেফতার চলছে, নির্যাতন, লুটপাট ছাড়াও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। গত সপ্তাহে দেশটির সরকার শত শত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করে বলে তারা পুলিশের ওপর হামলাকারী।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান যিনি রাখাইন স্টেটে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত এ্যাডভাইজরি কমিশনের প্রধান তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, উত্তর রাখাইন এলাকায় সাম্প্রতিক সহিংসতা গভীর উদ্বেগজনক যা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এ ঘটনায় নতুন করে মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর রাখাইন পরিস্থিতি নজরে রাখছে বলে জানিয়েছেন।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইন এস্টেটে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হামলার কথা অস্বীকার করলেও তাদের এ ধরনের অভিযানের পাশাপাশি সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে। এ ধরনের হামলার জন্যে সরকারি বাহিনী দায়ী বলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের স্যাটেলাইট ওয়াচে দেখা যাচ্ছে মংগদু জেলার কেইত ইয়ো ফিন পিন গ্রামে সাত দিন আগে যেসব ঘরবাড়ি দেখা গেছে এখন তা ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আক্রান্ত এলাকগুলোতে এনজিও বা সাংবাদিকদের যেতে দেয়া হচ্ছে না বলে ওসব অঞ্চল থেকে কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। রবার্টসন আরো বলেন, রাখাইনে যা ঘটছে তা আসলে সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাখাইন অঞ্চলে ৮ থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান থাকলেও তাদের কোনো নাগরিক স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার। তারা স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করতে না পেরে কোনো কাজও করতে পারছে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জমি বা সম্পদের কোনো অধিকার নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েক লাখ সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের হামলায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও বছরের পর বছর তাদের ফেরত নিচ্ছে না মিয়ানমার। এদের অনেকে সাগরপথে পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়ার সময় ক্ষুধা কিংবা নৌকা ডুবে মারা গেছেন।
গত মাসে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল স্টেট ক্রাইম ইনেশিয়েটিভ এ্যাট কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটির পরিচালক পেনি গ্রিন রাখাইন এস্টেটকে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্ধকূপ হিসেবে অভিহিত করেন। মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েল সম্প্রতি রাখাইন এস্টেট পরিদর্শন করে বলেছেন, সেখানার সন্ত্রাসী ঘটনার সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। এছাড়া সচ্ছতার সঙ্গে তথ্যের আদান প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
রাখাইন এস্টেটে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরু হয়েছে গত মাস থেকে। মিয়ানমারের সেনা সদস্য ও পুলিশ নিহত হবার পর ওই স্থানকে বিশেষ অভিযান এলাকা ঘোষণা করে যৌথ অভিযান শুরু হয়। সেনা সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকদের অস্ত্র নিয়ে অভিযানে অংশ নিতে দেখা গেছে। এক পর্যায়ে স্থানীয় যুবক যারা রোহিঙ্গা মুসলমান নয় তাদের অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। অভিযানের সময় মিয়ানমার বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে রাখাইন স্টেটে গোলাগুলী বর্ষণ করা হয়।
এদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডাব্লিউ স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছে, রাখাইনের মংদাউ জেলার তিনটি গ্রামের ৪৩০টি বাড়ি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এইচআরডাব্লিউর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডাম বলেছেন, স্যাটেলাইট চিত্রে ক্ষয়ক্ষতির যে বিবরণ পাওয়া গেছে বাস্তবে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।