Saturday, September 2, 2017

কেমন শান্তির দূত অং সান সু চি!


মিয়ানমারের পুনর্জাগরণের নেতা তিনি। সেনাবাহিনী যখন তাঁকে গৃহবন্দি করে, তাঁর মুক্তির দাবিতে জেল খাটেন অনেকে, করেন মৃত্যুবরণও। কিন্তু সু চির ঘনিষ্ঠরাই এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর অবস্থানে অবাক। ফিঁকে হয়ে এসেছে তাঁদের স্বপ্নও।

সুচির এই বিস্ময়কর পরিবর্তনের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে বার্মা থা দিন নেটওয়ার্ক নামে মিয়ানমারের একটি ব্যাঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন। তারা বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলরা ভাড়া করা রুশ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা অং সান সু চির শরীর থেকে গণতন্ত্রের জিন সরিয়ে একটা ক্লোন তৈরি করেছে। সত্যিকারের সু চি এখনও সেনাবাহিনীর কারাগারে বন্দি বলেও উল্লেখ করেছে থা দিন নেটওয়ার্ক।

স্পষ্টতই এটা একটা বানানো গল্প। কিন্তু মিয়ানমারের অসাম্প্রদায়িক জনগণের বিস্ময়ের সত্যিকার মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে এই ব্যাঙ্গাত্মক গল্পে। কয়েক বছর আগেও যে সু চি ধর্ম, সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলতেন, সেই সু চি কীভাবে এতটা বদলে গেলেন?

সুচি যখন কয়েক দশকের সেনা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, এক মেডিকেল ছাত্রী সব বাধা উপেক্ষা করে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়েছিল। সু চির প্রতি আনুগত্যের কারণে তাঁকে ছ'বছর কারাগারে কাটাতে হয়।

অসুস্থ হয়ে একবার বন্দি অবস্থাতেই মরতে বসেছিলেন তিনি। সেই ছাত্রী মা থিডাও এখন সুচির কর্মকাণ্ডে অবাক। মা থিডার মতো যারা সু চির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, এখন তাঁদের অনেকেই নিন্দা জানানোর ভাষাও খুঁজে পান না।

সু চির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের কিছু হলো – নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং মুসলিমদের প্রতি রাষ্টীয় সহিংসতাকে উপেক্ষা করা, সাংবাদিক এবং অ্যাকটিভিস্টদের কারাগারে পাঠানো, এখনও যথেষ্ট ক্ষমতাধর সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি নত হওয়া এবং পরবর্তী নেতা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করতে ব্যর্থ হওয়া।

সু চির বয়স এখন ৭২। অনেকেই বলছেন, যখন সু চি থাকবেন না, তখন নেতৃত্বে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হবে। আর সে শূন্যতা পূরণে আবার সেনাবাহিনীর হাতেই ক্ষমতা যাবে বলেও তাদের আশংকা। সু চি সবসময় গণতন্ত্রের কথা বলে আসলেও, তার মধ্যে সবসময়ই স্বৈরাচারী মনোভাব ছিল বলেও মনে করছেন অনেকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শুধু সেই মনোভাবকে উসকে দিয়েছে।

‘‘মাত্র দেড় বছরে পুরো দেশ পরিবর্তন করে ফেলবেন তিনি, তা আমরা আশাও করি না। কিন্তু মানবাধিকার রক্ষায় তাঁর অন্তত শক্ত ভূমিকা দরকার ছিল'', বলেন এককালে সু চির ঘনিষ্ঠ সহচর মা থিডা। একসময় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চিকে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করা হতো।

২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি নামের একটি সংগঠন ৩০টি পুলিশ চেকপোস্টে হামলার পর থেকে রাখাইন রাজ্যে শুরু হয়েছে নতুন করে সহিংসতা। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। সু চি এ জন্য দায়ী করেছেন ‘জঙ্গিদের'। বলেছেন, ‘‘রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও ঐক্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা রুখে দিতে এই হামলা। ''

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতন, রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের অধিকার কেড়ে নেয়ার অভিযোগ বিষয়ে সু চির কোনো বক্তব্য আজ পর্যন্ত স্থানীয়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসেনি। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সরাসরি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও উত্তরটা এড়িয়ে গেছেন সু চি।

উলটো, রাখাইনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন পাঠাতে চাইলেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় সু চির সরকার। উড়িয়ে দেয়া হয়েছে ‘মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে', জাতিসংঘের এমন বক্তব্যও উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ফেব্রুয়ারির এই প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ, মুসলিম নারীদের গণধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। এর সবকিছুর জন্যই মিয়ানমার সরকার দায়ী করে আসছে ‘মুসলিম জঙ্গিদের'। গণধর্ষণের অভিযোগ সম্পর্কে সু চির অফিশিয়াল ফেসবুক থেকে দেয়া হয় একটি ম্যাসেজ – ‘ফেক রেপ' বা ‘ভুয়া ধর্ষণ'।

‘‘আমাদের অবশ্য দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে তাঁর দল এবং সরকারকেই সমর্থন করতে হবে। কিন্তু সমস্যার শেকড় এতটাই গভীরে যে, আমাদের উচিত প্রত্যাশার মাত্রাটা কমিয়ে দেয়া'', বলেন থান্ট থাও কাউং। থান্ট মিয়ানমার বুক এইড অ্যান্ড প্রিজারভেশন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক।

কী হয়েছে সু চির!

বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে গেছেন সু চি। ১৫ বছর ধরে গৃহবন্দি ছিলেন, দেখা করতে পারেননি তাঁর ব্রিটিশ স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গেও। এই অনমনীয় মনোভাব তাঁকে এনে দেয় বিশ্বজুড়ে খ্যাতি।

২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পায় তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি। সু চিকে সেনাশাসন থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবেই দেখতো সাধারণ জনগণ। কিন্তু ২০১৬ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে ‘নির্লিপ্ত' এবং ‘তথ্য নিয়ন্ত্রণের' অভিযোগ আসছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে এর কারণ বুঝতে পারছেন না বিশ্লেষকরাও। সু চির বাবা জেনারেল অং সানকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মিয়ানমারের স্বাধীনতার লড়াইয়ে একজন নায়ক হিসেবেই দেখা হয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে কেউ কেউ বলছেন, সেনাবাহিনীর সাথেই সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সু চি।

আবার কেউ ধারণা করছেন, কষ্টে পাওয়া এই ক্ষমতা হারানোর ভয়ই তাঁকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধা দিচ্ছে। তবে এই যুক্তি মানতে নারাজ তাম্পাডিপা ইনস্টিটিউটের প্রধান খিন সাও উইন। সেনা শাসনের বিরোধীতা করে ১১ বছর জেল খেটেছেন খিন সাও।

তিনি মনে করেন, ‘‘এগুলো অযৌক্তিক কথাবার্তা। সু চি এখন আর সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি না। '' তিনি মনে করেন, মূল কারণ হলো সু চির নৈতিক সাহসের অভাব।

-ডিডাব্লিউ

মূলপাতা

সমগ্র বাংলাদেশ

এক্সক্লুসিভ